সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

তাকওয়া ও রমযান

মুমিনের জীবন চলার পথে আত্মিক ফুয়েল (জ্বালানি) সংগ্রহ করার অপূর্ব সুযোগ নিয়ে আবারো স্বমহিমায় হাজির হয়েছে পবিত্র রমজান। রমজানের মূল সাধনাই হলো সিয়াম। আর সিয়াম ফরজ করা হয়েছে তাকওয়া অর্জনের সুযোগ করে দিতে। এরশাদ হয়েছে, ‘হে ইমানদারগণ! তোমাদের ওপর ফরয করা হয়েছে সিয়াম যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের ওপর যেন তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পার।’ (সুরা বাকারা, ১৮৩)।
কুরআনুল কারিমে তাকওয়া শব্দটি এসেছে ১৫ বার। তাছাড়াও অনেকবার আল্লাহ তায়ালা ‘ইত্তাকু’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। সুরা বাকারার শুরুতেই বলেছেন ‘এই কিতাব যাতে কোনো সন্দেহ নেই এবং তা মুত্তাকীদের (খোদাভীরু) জন্য পথপ্রদর্শক’। হুজুরাতের ১৩নং আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন, ‘তোমাদের মাধ্যে সে ব্যক্তিই আল্লাহর কাছে সর্বাধিক সম্মানিত যে অধিক মুত্তাকি (তাকওয়া পরায়ন)।’ রাসূলে কারিম (সা.) মদিনায় হিজরতের পর বনু সালেম ইবনে আমর ইবনে আওফ (রা.)-এর গোত্রে সর্বপ্রথম জুমুয়ার নামাজ আদায় করেন। জীবনের প্রথম জুমুআর খুৎবায় তিনি বলেন ‘আমি তোমাদেরকে তাকওয়া অর্জনের জন্য বিশেষভাবে উপদেশ দিচ্ছি’ । হজরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, ‘আমি নবীজি (সা.)-কে বললাম, ইয়া রাসুলাল্লাহ আমাকে কিছু ওসিয়ত করুন। তিনি বললেন- আমি তোমাকে তাকওয়ার ওসিয়ত করছি।’ (মুসনাদে আহমাদ)। ইসলামের পঞ্চম খলিফা খ্যাত হজরত উমর ইবনে আব্দুল আজিজ (র.) জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত তার প্রথম ভাষণে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি তোমাদেরকে তাকওয়ার নির্দেশ দিচ্ছি’। উম্মতের প্রতি নবীজির (সা.) অসিয়ত তাকওয়ার, খোলাফায়ে রাশেদিনের ওসিয়ত তাকওয়ার সর্বোপরী তাকওয়া অর্জনের প্রশিক্ষণ হিসেবে আল্লাহ তায়ালা ১ মাস রোজা রাখা অত্যাবশ্যক করে দিলেন।
তাকওয়া কী? তাকওয়া অর্থ আল্লাহভীতি। তাফসিরে জালালাইনে এসেছে ‘আল্লাহর আদেশসমূহ পালন ও নিষেধগুলো থেকে বেঁচে থাকাই তাকওয়া।’ ব্যাপক অর্থে বলতে গেলে তাকওয়া তো মানুষের মনের আল্লাহর ভয়ে হালাল হারামের বিধানের প্রতি ঐ শ্রদ্ধা ও ভীতি যা মানুষের আচার-আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাকওয়ার বিধান নাযিলের মাধ্যমে বিশ্ব মানবতাকে তিনি যে সংবিধান নাযিল করেছেন তার প্রতি ভীত শ্রদ্ধ করতে চেয়েছেন। কারণ, জনগণ আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল না হলে কোনো আইনকেই প্রয়োগ করা সম্ভব নয়।
বর্তমানে সমাজ থেকে অপরাধ দমনে দুটি ব্যবস্থা বিদ্যমান ১. আইন (খধ)ি, ২. আইন প্রয়োগকারী সংস্থা (খধি বহভড়ৎপরহম ধমবহপু)। পৃথিবীর বাস্তবতা বলছে, এই দুই ব্যবস্থা সমাজ থেকে অপরাধ দমন করতে ব্যর্থ। আমরা দেখছি, যে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাজ হচ্ছে অপরাধ দমন করা সেই আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরাই হত্যা, মাদক চোরাচালান থেকে শুরু করে ভয়ঙ্কর অপরাধে লিপ্ত। এর মূল কারণ হচ্ছে তারা নিজেরাই আইনের প্রতি ভীত শ্রদ্ধ নয়। ১২ এপ্রিল শনিবার দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশের প্রধান খবর ছিল, ‘ঘাটে ঘাটে চাঁদাবাজি। মহাসড়কে পুলিশের চাঁদাবাজির ভয়ঙ্কর চিত্র উঠে আসে সেই প্রতিবেদনে। বহুল আলোচিত নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের সাথে নিজেদের সম্পৃক্ততা ইতোমধ্যেই র‌্যাব কর্মমর্তারা স্বীকার করেছেন। বিভিন্ন অপরাধে দেড় বছরে ১৩ হাজার ৭৪৫ পুলিশের বিরুদ্ধে সিকিউরিটি সেলে অভিযোগ জমা পড়েছে।  এর মধ্যে ১ হাজার ৮৮১ জনের বিরুদ্ধে আনা হয়েছে চুরি, ডাকাতি, খুন কিংবা ছিনতাইয়ের মতো গুরুতর অপরাধের অভিযোগ। (দৈনিক যুগান্তর- ১০ আগস্ট, ২০১৩)। টিআইবির প্রতিবেদনেও অপরাধে শীর্ষে রয়েছে পুলিশ। টিআইবির রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে যেই পুলিশকে বেতন দেয়া হচ্ছে দুর্নীতি দমনের জন্য সেই পুলিশই দুর্নীতিতে শীর্ষে! কে জানে টিআইবি নিজেই দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন কি-না! পুলিশকে মনটিরিং করার জন্য রয়েছে সংস্থা আবার সেই সংস্থাকেও মনিটরিং করা হচ্ছে, কিন্তু এতেও কোনো কাজ হচ্ছে না। এই অবস্থার একমাত্র কারণ, পরকালের সর্বোচ্চ আদালতে জবাবদিহিতার ভয় নেই তাদের অন্তরে। আমার অপরাধ আল্লাহ দেখছেন এই প্রবণতা নেই তাদের অন্তরে। একটি দেশের ক্ষুদ্রতম ইউনিট (একক) হচ্ছে নাগরিক, প্রত্যেকটি নাগরিক যতক্ষণ আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল না হবে ততক্ষণ সে আইন সমাজে বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়।
তাই আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এই পৃথিবীকে অপরাধ থেকে মুক্ত করার জন্য যে ঐশী ব্যবস্থাপত্র দিয়েছেন তার ধাপ হচ্ছে ৩টি। ১. আইন (কুরআন-সুন্নাহ), ২. তাকওয়া (আইনের প্রতি মানুষকে ভীতশ্রদ্ধ করে তোলা)। ৩. আইন প্রযোগকারী সংস্থা (খধি বহভড়ৎপরহম ধমবহপু)। এই ব্যবস্থাপত্র শতভাগ সফল। কারণ এতে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আইন প্রণয়নের পরই মানুষকে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল করার বিষয়টিতে গুরুত্ব দিয়েছেন।
সুরাতুল মায়েদার ৯০নং আয়াতের মাধ্যমে যখন মদ হারামের আয়াত নাযিল হল তখন রাসুলে আকরাম (সা.) হাফেজ সাহাবিদেরকে নির্দেশ দিলেন গলিতে গলিতে আয়াত পাঠ করার জন্য। আইন প্রণেতার ভয় এবং আইনের প্রতি শ্রদ্ধার ফলে তখন কোনো আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোক ছাড়াই সাহাবায়ে কোরাম (রা.) মদ ত্যাগ করলেন। মদ নিষিদ্ধ হওয়ার ঘোষণা শুনে যার হাতে মদের গ্লাস ছিল তিনি তা ছুড়ে ফেললেন; যার মুখে মদ ছিল তিনি তা ফেলে দিয়ে কুলি করলেন; যিনি ঐ সময় মদ পানরত ছিলেন তিনি গলায় আঙ্গুল দিয়ে বমি করে পেট থেকে মদ বের করার চেষ্টা করলেন। যার বাড়িতে মদের কলসি ছিল তিনি লাথি মেরে তা ভেঙ্গে ফেললেন। মদিনার রাস্তায় মদ বয়ে গেল। (ইবনে কাসির)
তাকওয়ার ফলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ছাড়াই আইন বাস্তবায়ন হয়ে গেল। এই হচ্ছে তাকওয়ার উপকারিতা। থাকলে মানুষ গোপনেও অপরাধ করবে না। কেননা তার চিন্তা কখনো আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কবল থেকে খালি হবে না। হযরত ওমর (রা.) এক রাতে মানুষের খোঁজখবর নেয়ার জন্য মদিনার অলিগলিতে টহল দিচ্ছিলেন। হঠাৎ তিনি একটি ঘর থেকে কথাবার্তার শব্দ শুনতে পেলেন। তার কৌতুহল হলো। তিনি ঘরের দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়ালেন এবং শুনতে পেলেন, এক বৃদ্ধা তার মেয়েকে বলছে, ‘বেটি! আজ তো উটের দুধ কম হয়েছে। দুধের সঙ্গে একটু পানি মিশিয়ে দাও! মেয়ে বললো, মা! আমিরুল মুমিনিন তো দুধে পানি মেশাতে নিষেধ করেছেন। বৃদ্ধা বললো, আমিরুল মু’মিনিন কি আমাদের দেখছেন? তিনি হয়তো নিজ ঘরে ঘুমিয়ে আছেন। এবার মেয়ে বললো, মা! আমিরুল মু’মিনিন এখানে নেই এবং তার কোনো লোকও নেই, কিন্তু আল্লাহ তায়ালা তো আছেন। তিনি তো দেখছেন। তার কাছে কী জবাব দেবো?
আল্লাহর ভয় থাকলে রাতের অন্ধকারেও অন্যায় থেকে বিরত থাকা সম্ভব বলেই তাকওয়ার প্রতি আল্লাহ এতো গুরুত্ব দিয়েছেন। তাকওয়ার মাধ্যমে অপরাধ দমন হবে সমাজ থেকে। মানুষ বাঁচবে মানুষের অনিষ্ট থেকে। রমাজনের এ প্রশিক্ষণ আমাদের সামাজিক জীবনে বয়ে আনবে অনাবিল শান্তি।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

‘হুদ হুদ’ প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত

ঘূর্ণিঝড় ‘ হুদ হুদ ’ উত্তরপশ্চিম দিকে অগ্রসর ও ঘণীভূত হয়ে অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়েছে। এটি অবস্থান করছে পশ্চিম মধ্যবঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন পূর্ব মধ্যবঙ্গোপসাগর এলাকায়। ·          অগ্রসর হচ্ছে ‘ হুদ হুদ ’, সাগরে সতর্কতা সংকেত ·            ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে সাগর উত্তাল থাকায় চট্টগ্রাম , কক্সবাজার , মংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে তিন নম্বর স্থানীয় সর্তকতা সংকেত দেখিয়ে যেতে বলেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। আবহাওয়া অধিদপ্তর শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টার বুলেটিনে এ তথ্য দেওয়া হয়। এতে বলা হয় , ঘূর্ণিঝড়টি সন্ধ্যা ৬টায় চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ৯৭৫ কিলোমিটার দক্ষিণপশ্চিমে , কক্সবাজার সমুদ্রবন্দর থেকে ৯১০ কিমি দক্ষিণপশ্চিমে , মংলা সমুদ্রবন্দর থেকে ৮৮০ কিমি দক্ষিণ-দক্ষিণপশ্চিমে এবং পায়রা সমুদ্র বন্দর থেকে ৮৭০ কিমি দক্ষিণ-দক্ষিণপশ্চিমে অবস্থান করছে। এটি আরও ঘণীভূত হয়ে পশ্চিম-উত্তরপশ্চিম দিকে অগ্রসর হতে পারে। এ সময় ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৭৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ১২০ কিমি থেকে ...

রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বাতিলের সম্ভাব্য পরিণতি!!!

সংবিধান থেকে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম তুলে দিলে আমরা যে সকল সমস্যার সম্মুখীন হতে পারি ➖➖➖➖➖➖➖➖➖➖ শুধুমাত্র লাইক, কমেন্ট, শেয়ার, কপিই নয়! সম্ভব হলে লিফলেট ছেপে লেখাটি ছড়িয়ে দিন!! : রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বাতিলে সমস্যা কোথায়? প্রশ্নবানে জর্জরিত হচ্ছি, সমস্যা কোথায়? প্রশ্ন আসছে সব শ্রেণী থেকে। প্রথম কথা হচ্ছে, কেউ আমার হাত কাটলেও ব্যথা পাই, আঙুল কাটলেও। কারণ হাত-পা সবই আমার! ইসলামী বিধান প্রতিষ্ঠিত নাই বলে সংবিধান থেকেও মুছে দিতে হবে? হাত কাটা রুখতে পারি নি বলে পা কাটারও সুযোগ দেবো? কারো শরীরে অনুভূতি না থাকলে সেটা তার ব্যাপার, আমি কালিমা পড়েছি, দ্বীনের যে কোন বিষয়ে আঘাত আসলে আমার কলিজায় লাগে! এবার আসল কথায় ফিরে যাই; ক. ইসলামী শরী’আহ হচ্ছে কোন বিধান পালন না করলে আপনি গুনাহগার, বেঈমান নন, কিন্তু অস্বীকার করলে বেঈমান। সংবিধান থেকে সরিয়ে দেওয়ার অর্থ হচ্ছে আপনি অস্বীকার করছেন! খ. বুদ্ধিমানদের কাজ হচ্ছে ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়া, আপনি কামাল আতার্তুকের তুরস্কের ইতিহাস পড়ুন, বুঝবেন কেন আমাদের এতো মাথাব্যথা! গ. প্রধানমন্ত্রী তনয় ও আইটি উপদেষ্টা জয় সাহেবের সে বক্তব্...
ইসরাইলি পণ্যকে হালাল বলা , মাজহাব মানা হারাম ও শিরক বলা সহ আরও আনেক লাগামহীন কথার নায়ক ইহুদীদের দালাল এই ইবলিস- কে একটু শিক্ষা দিয়ে আসুন । https://www.facebook.com/md.rohan.7359447?ft[ego_id]=100007949353950&ft[qid]=6035260132232542925&ft[mf_story_key]=627004182696301145&ft[ei]=&ft[fbfeed_location]=1&ft[insertion_position]=1&__md__=1